১ম বর্ষ,৫ম সংখ্যা,১৫ ই জুন ,২০১৪। ১লা আষাঢ়,১৪২১

১ম বর্ষ,৫ম সংখ্যা,১৫ ই জুন ,২০১৪। ১লা আষাঢ়,১৪২১

Thursday, February 13, 2014

ইলা মুৎসুদ্দী এর ভ্যালেন্টাইন ভাবনা



ভ্যালেন্টাইন ডে হোক আনন্দময়
ইলা মুৎসুদ্দী
আজ বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো, আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো
এই সংগীত মুখরিত গগনে।
তব গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো, এই বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে
দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।......রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমরা এখন সবাই জানি ১৪ ফেব্রুয়ারী সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে- বিশ্ব ভালবাসা দিবস। ভালবাসার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেয় কঠিন। মানুষকে পরিপূর্ণ আনন্দ দিতে যে কয়েকটি অনুভূতি কাজ করে তার মধ্যে অন্যতম হলো ভালবাসা।ভালবাসা বিষয়টাই খুবই গোলমেলে, অষ্পষ্ট এবং ধোঁয়াটে। এর ব্যাপ্তি এতটাই বিশাল যে, কোনো সংজ্ঞা দিয়ে একে আজ অবধি সংজ্ঞায়িত করা যায় নি। সংজ্ঞা দিয়ে যেমন এর মানে খোঁজা যায় না, তেমনি শব্দ দিয়েও একে ব্যাখ্যা করা যায় না্ তারপরও অনেকেই ব্যাখ্যাতীত এই ভালোবাসার সংজ্ঞা খুঁজে বেড়ান চিরকাল। মানুষ মানুষকে ভালবাসবে এটাই স্বাভাবিক। তারপরও সব মানুষের ভীড়ে নির্দিষ্ট একজন মানুষ হয়ে উঠেন সবচেয়ে বেশি প্রিয়। ভালবাসা কারো কাছে আনন্দের, আবার কারো কাছে বিষাদের। হয়তো এটাই জীবন। ভালবাসার আবেদন এক একজন মানুষের কাছে একেক রকম।
ভালবাসার চিরন্তন বহিঃপ্রকাশ এই দিনটি একটু আলাদা ঢং ও আঙ্গিকে অনুরণিত হবে। আহবান বাণী উচ্চারিত হবে ভালবাসার অবগাহনে সিক্ত হতে। প্রেম ভালবাসা আমাদের জীবনের এক চিরন্তন সত্য। যা ছাড়া জীবনের গতিপথ থমকে যায়। অনিবার্য যার উপস্থিতি সেই প্রেম ভালবাসার বিশালতায় সকলের মধ্যে ভালবাসার স্ফুরণ হোক ভ্যালেন্টাইন ডে-র মধ্য দিয়ে। এই দিনে প্রিয়জনের সাক্ষাৎ হলে নিশ্চয় আমরা ভুলে যাবো না ভ্যালেন্টাইন ডে-র কথা মনে করিয়ে দিতে। যেমনি হয়ত নির্লিপ্ত থাকবো না কাছের প্রিয় মানুষটিকে ছোট্ট উপহার দিতে বা নিদেনপক্ষে টেলিফোন বা মোবাইলের একটি এসএমএস পাঠাতে, হ্যালে ভ্যালেন্টাইন ডে। তারুণ্যের আবেগ উচ্ছলতার ঢেউ হয়ত আছড়ে পড়বে প্রতি মুহুর্তে তীর ভাঙ্গা ঢেউয়ের বেগে মন ও মননে কিন্তু ক’জনই বা আমরা জানি ভ্যালেন্টাইন দিনের গোড়াপত্তনের ইতিহাস। ভ্যালেন্টাইন ডে-র ইতিহাস নিয়ে নানা ধরণের গল্প কাহিনী প্রচলিত আছে। আমি সেই সব কাহিনীর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।২৬৯ সালের এই দিনে রোমান সাম্রাজ্যের রোম নগরীতে ভ্যালেন্টাইন ডে-র উৎপত্তি হয়। পাদ্রী যাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস খৃষ্টধর্ম পরিত্যাগ করতে আহবান জানান।তিনি ধর্ম ত্যাগে অস্বীকার কররে ২৬৯ এর ১৪ ফেব্রুয়ারী তাকে হত্যা করা হয়।
পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত হয়েছে, সে সময় রোমানদের মধ্যে দেবদেবীর পূজার প্রচলন ছিলো।পাদ্রী সেন্ট ভ্যালেন্টাইন রোমে খৃষ্টধর্মের প্রচার শুরু করেন। রোম সম্রাট ক্লডিয়াস এজন্য ভ্যালেন্টাইন এর উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন।ভ্যালেন্টাইন-কে বন্দী করে জেলে নিক্ষিপ্ত করা হয়। জেলখানায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে, যুবক-যুবতীরা ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে আসতো এবং ভালবাসা ও একাত্মতা জানাতে জেলের জানালা দিয়ে চিঠি ও ফুল দিতো।তিনি নিজে একজন চিকিৎসক ছিলেন এবং এই সুবাদে ঐ জেলের জেলারের অন্ধ মেয়ের চিকিৎসা করে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন।মেয়েটির সাথে পরবর্তীতে ভ্যালেন্টাইনের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবার আগ-মুহুর্তে ভ্যালেন্টাইন জেলারের কাছে এক টুকরো কাগজে মেয়েটির উদ্দেশ্যে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লিখে পাঠান ‘লাভ ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন’। ভালবাসার এই হৃদয়ছোঁয়া আকুতিকে সম্মান দেখাতে ও ইতিহাসে স্মরণীয় করতে পোপ ১ম জুলিয়াস ৪৯৬ খৃষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারীকে ভ্যালেন্টাইন ডে ঘোষণা করেন।
ভ্যালেন্টাইন ডে-র আরেকটি উপাখ্যান হলো, রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন ও স্বেচ্ছাচারী।তিনি প্রায় সময় অযাচিত রক্তযুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন সাম্রাজ্য সীমানা ও ক্ষমতা পরিবর্ধরে। এজন্য তার প্রয়োজন ছিল বিরাট সৈন্যবাহিনীর। এক সময সেনাবাহিনীতে সেনা সংকট দেখা দিলে রোমবাসীর প্রেম, মমতা-ভালবাসাকে দায়ী করেন ক্লডিয়াস এবং যুবক-যুবতীদের বাগদান ও বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এসময় ভ্যালেন্টাইন নামের এক যুবক ভালবেসে স্টে মরিয়াসকে বিয়ের মাধ্যমে রাজার আদেশকে অবজ্ঞা করেন। শুধু নিজে বিয়ে করে থেমে থাকেননি বরং গোপনে আরও বিয়ের কাজ চালাতে থাকেন। এ সংবাদে ক্লডিয়াস ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। একসময় সেন্ট সেন্ট ভ্যালেন্টাইন রাজার সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন। দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারী ২৭০ খ্রিঃ। হাত পা বেধে টেনে-হিচড়ে ক্লডিয়াসের সামনে হাজির করা হলে ভ্যালেন্টাইনকে পিটিয়ে হত্যা ও শিরচ্ছেদ এর আদেশ দেন তিনি। এ দিনের শোকগাথায় আজকের ভ্যালেন্টাইন ডে।
আর একটি কাহিনী হলো-প্রাচীন রোমে জুনোর সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারী ছুটি পালন করা হতো। জুনো ছিলেন দেবতাদের রাণী। রোমানরা এও বিশ্বাস করতো জুনোর ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়া কোন বিয়ে সফল হয় না্। ছুটির পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারী লুপারকালিয়া ভোজ উৎসবে তরুণীরা তাদের নাম এক টুকরো কাগজের স্ক্রিপে লিখে সবার সামনে রাখা একটি বড় পাত্রে ফেলে দিতো। একেক জন তরুণ একটি স্কিপ্ট পাত্র বা জার থেকে তুলে দিতো এবং তরুণী ললনার নাম ধরে কাছে ডেকে নিতো। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি পর্যন্ত চলতো হাজারো তরুণী যুগলের আনন্দ, খশি। কখনও বা এই জুটি সারা বছরের জন্য স্থায়ী হতো এবং এর মধ্য দিয়ে চির ভালবাসার সিড়ি বেয়ে বিয়েতে পরিণতি ঘটতো। এভাবেই অব্যাহতরুপে ১৪ ফেব্রুয়ারীতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন প্রেমের পূজারী সিদ্ধপুরুষরুপে ভালবাসার বানী বিনিময়ের মূর্ত প্রতীক।
ভ্যালেন্টাইন ডে-প্রচলনের এই হলো আদি ইতিহাস। ঐ পঞ্চম (৪৯৬ খ্রীঃ)শতক থেকেই দিনটিতে কবিতা, ফূল, উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে প্রিয়জনের বিশেষ স্মরণের রেওয়াজ শুরু হয়। যদিও ভ্যালেন্টাইন ডে কে  ঘিরে মুখে মুখে এসব শোক, গল্প গাঁথা কিন্তু তার প্রমাণ একটু তর্ক সাপেক্ষ। তবুও সারা বিশ্বের প্রেমিকরা এদিনের মর্মার্থ লালন করে গভীর আন্তরিকতায় ও আবেগের সাথে। ভালবাসার চিরায়ত বহিঃপ্রকাশের এই দিনটি পশ্চিমা সংষ্কৃতিতে উদযাপনের ইতিহাস হাজার বছরের। কিন্তু বাংলাদেশে এ দিনটি বহু প্রচলন তথা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তারুণ্যে অনুপ্রবেশ ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে।ভ্যালেন্টাইন ডে বর্তমানে আমাদের সংষ্কৃতি ও তারুণ্যে উদ্ভাসিত একটি দিন। ভ্যালেন্টাইন ডে-র ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বিশ্বাসের সাথে আমাদের সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের গুণগত তফাৎকে সামনে রেখেই ভ্যালেন্টাইন ডে যেন সারা বছর আমাদের হৃদয়ে প্রেম-ভালবাসা ও মানবিক গুনাবলী উৎসরণে সহায়ক হয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে ভালবাসার ত্রিভূজ সূত্র বলে ভালবাসা মনে ১) অন্তরঙ্গতা ২) কমিটমেন্ট ৩) আকাঙ্খা এই তিনটি আবেগের সংমিশ্রণ। ভালবাসা মানে কারো কাছে নির্ভরতা খুঁজে পাওয়া, একে অপরের বিশ্বস্ত হওয়া, একে অপরের কাছে ভাল থাকবার ও ভাল রাখবার নীরব অঙ্গীকার, ভালবাসা মানে এই ধুলিমাখা ধরণীর সকল মলিনতা, পঙ্কিলতাকে আড়াল করে কিছুটা ভাললাগা, কিছুটা শান্তির সময় খুঁজে নেয়া।
একটি কথা না বললেই নয়, এই প্রেম ভালবাসাকে জীবিকা করে একটি চক্র অনেক নারীর জীবন অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছে। কয়েকদিন আগে ইডেন কলেজের ছাত্রী আঁখিকে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে জনসমক্ষে এসিড ছুড়ে মেরেছে। এক প্রেমিক তার প্রেমিকাকে চলন্ত ট্রেনের নিচে ধাক্কা মেরে হত্যা করেছে। এরকম হাজারো ঘটনা প্রতিদিন অহরহ ঘটছে। এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাইনা। সকলের মনন-মানসিকতায় প্রযুক্তির আধুনিকতার সৌন্দর্য্য বিরাজ করুক এই প্রত্যাশা রইল
পরিশেষে করিগুরুর চরণ দিয়ে শেষ করছি-
ভাবি যখন ভেবে না পাই তবে, দেবার মতো কী আছে এই ভবে
কোন থনিতে কোন ধনভান্ডারে, সাগরতলে কিম্বা সাগর-পারে,
যক্ষরাজের লক্ষমণির হারে, যা আছে তা কিছুই তো নয় প্রিয়ে
তাইতো বলি যা কিছু মোন দান, গ্রহণ করেই করবে মুল্যবান
আপন হৃদয় দিয়ে।
ভ্যালেন্টাইন ডে-র মর্মবাণী সকলের হৃদয়ে অনুরণিত হোক। সকলের প্রতি রইলো ভ্যালেন্টাইন ডে-র একরাশ অনাবিল ভালবাসা।
লেখকঃ কলাম লেখক, elamutsuddy@yahoo.com

No comments:

Post a Comment