১ম বর্ষ,৫ম সংখ্যা,১৫ ই জুন ,২০১৪। ১লা আষাঢ়,১৪২১

১ম বর্ষ,৫ম সংখ্যা,১৫ ই জুন ,২০১৪। ১লা আষাঢ়,১৪২১

Thursday, May 15, 2014

মা কে নিয়ে লেখা ইলা মুৎসুদ্দী এর খোলা চিঠি

যে চিঠি কখনো পৌঁছুবে না
                                               ইলা মুৎসুদ্দী 
মা,
তুমি কেমন আছো? ঐ দূর আকাশের নীলিমায় তারা হয়ে কিভাবে আছো মা? তোমার কি কখনো ভুলেও মনে পড়ে না তোমার অসহায় ছেলে-মেয়েদের কথা? যাদের তুমি সবসময় বুকে আগলে রেখেছিলে শত সহস্র ঝড় ঝাপটা সয়ে। কখনো একটুখানি আচড় লাগতে দাওনি কারো গায়ে। মা তুমি তো ছিলে গ্রাম্য এক গৃহবধূ। যাঁকে গাইড করার মতো একজন কেউ ছিল না। সবসময় দেখতাম তুমিই বাবাকে গাইড করতে। সবকিছু এত সুন্দরভাবে ম্যানেজ করতে সবাই তোমার প্রশংসায় ছিল পঞ্চমুখ। তোমার সবচাইতে বেশী পছন্দ ছিল মানুষকে খাওয়ানো। তোমার পিঠা বানানোর কথা তোমার মৃত্যুর দিন শবানুষ্টানে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছে। তোমার উদার দানশীল মন মানসিকতার জন্য সবাই তোমাকে খুউব পছন্দ করতো। গ্রামবাসী সবাই কোন সমস্যায় পড়লে আগে তোমার কাছে ছুটে যেত। সেটা কোন অসুখ হোক কিংবা কোনকিছু ধার দেনা হোক। জানো মা, তুমি চলে যাওয়ার পর সবাই প্রতিদিন, প্রতি ক্ষণ তোমাকে, তোমার সু-কর্মগুলোকে স্মরণ করে। যখনি গ্রামে যাই, সবার কাছে শুধু তোমার প্রশংসা শুনি। তখন গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়। তোমার মত মায়ের গর্ভে জন্মেছি সেও নিশ্চয়ই কোন সুকর্মের প্রভাবে। আচ্ছা মা তুমি কি দেখতে পাও তোমার সন্তানদের? তোমাকে ছাড়া আমাদের কি অসীম দুঃখ, বেদনা হাহাকার তা তুমি বোঝ না? কেন তুমি আমাদের মাঝে আবার চলে আস না?  তুমি যখন আমাদের কাছে ছিলে তখন আমরা এই কষ্টটা কখনো বুঝিনি। কখনো ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি তোমাকে হারাতে হবে। জানো মা সন্তানদের কাছে সবচাইতে কষ্টের জিনিস কি? তা-হলো অসময়ে মা-কে হারানো। তুমি সবসময় বাবার কথা চিন্তা করতে। অথচ তুমিই বাবাকে একা ফেলে আগে চলে গেলে। যদি তোমার যাওয়ার সময় হতো তাহলে আমরা মেনে নিতাম। এখনতো মনকে কোনভাবেই বুঝাতে পারি না। তুমিহীনা সেই ঘরে আর যেতে ইচ্ছে করে না। আমরা কেউ বাড়িতে যাচ্ছি শুনলে, আগেই পথের সামনে দৌড়ে এসে দাড়িয়ে থাকতে। আর আমাদের দেখে উচ্ছসিত হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে। এখনতো কেউ আসে না। সবসময় তোমার জন্য প্রাণ কাঁদে। একা একা কান্না করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আগে তুমি ছিলে। তোমাকে সব কথা বলতাম। এখন কাকে বলব মা? সবার বড় সন্তান হওয়াতে আমাকে বেশী আদর করতে। বিয়ে হওয়ার পর থেকেই একমাত্র আমিই তোমাকে না দেখে থাকতে পারতাম না বলেই প্রায় প্রতি সপ্তাহে তোমাকে দেখতে যেতাম। এক সপ্তাহ দেরী করলে তোমার ভিতর ছটফটানি শুরু হতো। সাথে সাথে আমার ভিতরও একধরণের হাহাকার শুরু হতো। যখনি আবার তোমার সামনে যেতাম, সবকিছু ঠিক হয়ে যেতো। এখন শত হাহাকারে বুক ভেঙ্গে গেলেও তোমাকে দেখার উপায় নেই। মা-তুমি তো বলতে তোমাকে অমুক বলেছে, তোমার মেয়ের লিখা উঠেছে পত্রিকায়। তুমি কত খুশি হয়ে আমাকে বলতে। আজ তোমাকে নিয়ে লিখছি মা--- তুমি কি খুশি হয়েছো মা? কেন আমাকে আজ লিখার কাঠগড়ায় দাড় করালে? আমরা চার ভাইবোনকে প্রতিষ্টিত করে দিয়ে তুমি চলে গেলে। মা জানো, টুটু খুব দুঃখের সাথে বলেছে, আজ যদি আমাদেরকে লেখাপড়া না শিখিয়ে বকলম বানিয়ে রাখতে তাহলে তোমার চলে যাওয়ার সময় আমরা ভাইবোনেরা হয়তো তোমার পাশে থাকতাম। আমরা তোমার এমন দুর্ভাগা সন্তান চলে যাওয়ার সময় একটা সন্তানের মুখও দেখে যেতে পারোনি। তারপরও তুমি অনেক পূণ্যবান মা। (২০০৬ সালের ৯ই ফেব্র“য়ারী) কাউকে একটুও কষ্ট না দিয়ে মিনিটের মধ্যেই সবকিছু শেষ করে দিয়ে চলে গেলে। বাবাও বুঝতে পারেনি মা তুমি যে চলে গেছ। তোমার জন্য বাবা এলোপাতাড়ি দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে এনেছে। তখন তো সব শেষ মা। আগের সপ্তাহে তোমার সাথে দেখা করে এসেছি। সেই দেখা যে শেষ দেখা হবে বুঝতে পারিনি মা। তুমি আমার জন্য পিঠা বানিয়ে রেখেছিলে। আমাকে আদর করে ভাত খাইয়েছ। আবার আমার ব্যাগ হাতে নিয়ে আমাকে গাড়ীতে তুলে দিয়েছ। জানো মা, সেদিন তোমাকে দেখে আসার পর থেকে আমার মনে একটা দাগ কেটে গিয়েছিল। আমার থেকে সবসময় মনে হয়েছে তোমার মুখখানি খুব ফ্যাকাসে সাদা হয়ে গেছে। বুঝতে পারিনি মা, চলে যাবে বলে মনের ভিতরে গভীর বেদনার ছাপ পড়েছিল। মা তোমার বিহনে আমার খুউব খুউব কষ্ট মা। একটা সুন্দর শাড়ী দেখলেই তোমার কথা মনে পড়ে। মনে হয় এই শাড়ীটা পরলে তোমাকে খুব মানাতো। তোমাকে শাড়ী কিনে দিলে তুমি কত আশীর্বাদ করতে। তুমি তো নেই মা --- কার জন্য শাড়ী কিনব? আমি শুধু সবসময় তোমার বয়সী মহিলাদের দিকে হা করে চেয়ে থাকি আর তোমার কথা ভাবি। জানো মা, তুমি চলে যাওয়ার ছয় মাস হয়নি, বাবুল কাকাও তোমার মত হঠাৎ করে চলে গেছে খুব অসময়ে। কেন এমন হলো মা? তুমি বেঁচে থাকলে খুব কষ্ট পেতে মা। সবশেষে বলি মা ---- আমাদের ভান্তে সবসময় তোমার কথা বলে, ভান্তের নাকি মনে হয় তুমি সবসময় আশেপাশেই আছ। তুমি নেই, একথাটা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। আরো এটা কথা না বললে খুব অপরাধী হবো মা। সেটা হচ্ছে তোমার মৃত্যুর শবানুষ্টানে দেশবাসী সবাই যেরকম সহযোগীতা করেছে, সেটা কোনদিন ভুলতে পারব না। বিশেষ করে অনিল দাদুর পুরো পরিবার, প্রদীপ দাদা, দীলিপ দাদা, শিলীপ দাদা এবং আরো সবাই অকৃপণ সহযোগীতা করেছে। তাঁদের সবার কাছে আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। মা যদি তুমি পারো আবার ফিরে এসো, তোমার প্রিয় সন্তানদের কাছে। আমার এই আবদারটুকু রাখবে না মা? সারাজীবন তো শুধু জ্বালিয়েছি বিভিন্ন বায়না ধরেছি, এটা দিতে হবে, ওটা দিতে হবে। সব তো দিয়েছ মা, পূর্ণ করেছ সব আশা। এইবার শেষ আবদারটুকু রেখো মা। তোমাকে খুউব দেখতে ইচ্ছে করছে মা। যে মা-কে এক সপ্তাহ না দেখলে ছটফট করতাম প্রতিনিয়ত, সেই মাকে আজ সাত বছর না দেখে কিভাবে আছি? তুমিও মা কিভাবে আছো আমাদের না দেখে? খুউব জানতে ইচ্ছে করে -------কেমন আছো মা?

ইতি
তোমার আদরের মেয়ে 

No comments:

Post a Comment