১ম বর্ষ,৫ম সংখ্যা,১৫ ই জুন ,২০১৪। ১লা আষাঢ়,১৪২১

১ম বর্ষ,৫ম সংখ্যা,১৫ ই জুন ,২০১৪। ১লা আষাঢ়,১৪২১

Thursday, May 15, 2014

মা কে নিয়ে লেখা ইলা মুৎসুদ্দী এর খোলা চিঠি

যে চিঠি কখনো পৌঁছুবে না
                                               ইলা মুৎসুদ্দী 
মা,
তুমি কেমন আছো? ঐ দূর আকাশের নীলিমায় তারা হয়ে কিভাবে আছো মা? তোমার কি কখনো ভুলেও মনে পড়ে না তোমার অসহায় ছেলে-মেয়েদের কথা? যাদের তুমি সবসময় বুকে আগলে রেখেছিলে শত সহস্র ঝড় ঝাপটা সয়ে। কখনো একটুখানি আচড় লাগতে দাওনি কারো গায়ে। মা তুমি তো ছিলে গ্রাম্য এক গৃহবধূ। যাঁকে গাইড করার মতো একজন কেউ ছিল না। সবসময় দেখতাম তুমিই বাবাকে গাইড করতে। সবকিছু এত সুন্দরভাবে ম্যানেজ করতে সবাই তোমার প্রশংসায় ছিল পঞ্চমুখ। তোমার সবচাইতে বেশী পছন্দ ছিল মানুষকে খাওয়ানো। তোমার পিঠা বানানোর কথা তোমার মৃত্যুর দিন শবানুষ্টানে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছে। তোমার উদার দানশীল মন মানসিকতার জন্য সবাই তোমাকে খুউব পছন্দ করতো। গ্রামবাসী সবাই কোন সমস্যায় পড়লে আগে তোমার কাছে ছুটে যেত। সেটা কোন অসুখ হোক কিংবা কোনকিছু ধার দেনা হোক। জানো মা, তুমি চলে যাওয়ার পর সবাই প্রতিদিন, প্রতি ক্ষণ তোমাকে, তোমার সু-কর্মগুলোকে স্মরণ করে। যখনি গ্রামে যাই, সবার কাছে শুধু তোমার প্রশংসা শুনি। তখন গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়। তোমার মত মায়ের গর্ভে জন্মেছি সেও নিশ্চয়ই কোন সুকর্মের প্রভাবে। আচ্ছা মা তুমি কি দেখতে পাও তোমার সন্তানদের? তোমাকে ছাড়া আমাদের কি অসীম দুঃখ, বেদনা হাহাকার তা তুমি বোঝ না? কেন তুমি আমাদের মাঝে আবার চলে আস না?  তুমি যখন আমাদের কাছে ছিলে তখন আমরা এই কষ্টটা কখনো বুঝিনি। কখনো ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি তোমাকে হারাতে হবে। জানো মা সন্তানদের কাছে সবচাইতে কষ্টের জিনিস কি? তা-হলো অসময়ে মা-কে হারানো। তুমি সবসময় বাবার কথা চিন্তা করতে। অথচ তুমিই বাবাকে একা ফেলে আগে চলে গেলে। যদি তোমার যাওয়ার সময় হতো তাহলে আমরা মেনে নিতাম। এখনতো মনকে কোনভাবেই বুঝাতে পারি না। তুমিহীনা সেই ঘরে আর যেতে ইচ্ছে করে না। আমরা কেউ বাড়িতে যাচ্ছি শুনলে, আগেই পথের সামনে দৌড়ে এসে দাড়িয়ে থাকতে। আর আমাদের দেখে উচ্ছসিত হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে। এখনতো কেউ আসে না। সবসময় তোমার জন্য প্রাণ কাঁদে। একা একা কান্না করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আগে তুমি ছিলে। তোমাকে সব কথা বলতাম। এখন কাকে বলব মা? সবার বড় সন্তান হওয়াতে আমাকে বেশী আদর করতে। বিয়ে হওয়ার পর থেকেই একমাত্র আমিই তোমাকে না দেখে থাকতে পারতাম না বলেই প্রায় প্রতি সপ্তাহে তোমাকে দেখতে যেতাম। এক সপ্তাহ দেরী করলে তোমার ভিতর ছটফটানি শুরু হতো। সাথে সাথে আমার ভিতরও একধরণের হাহাকার শুরু হতো। যখনি আবার তোমার সামনে যেতাম, সবকিছু ঠিক হয়ে যেতো। এখন শত হাহাকারে বুক ভেঙ্গে গেলেও তোমাকে দেখার উপায় নেই। মা-তুমি তো বলতে তোমাকে অমুক বলেছে, তোমার মেয়ের লিখা উঠেছে পত্রিকায়। তুমি কত খুশি হয়ে আমাকে বলতে। আজ তোমাকে নিয়ে লিখছি মা--- তুমি কি খুশি হয়েছো মা? কেন আমাকে আজ লিখার কাঠগড়ায় দাড় করালে? আমরা চার ভাইবোনকে প্রতিষ্টিত করে দিয়ে তুমি চলে গেলে। মা জানো, টুটু খুব দুঃখের সাথে বলেছে, আজ যদি আমাদেরকে লেখাপড়া না শিখিয়ে বকলম বানিয়ে রাখতে তাহলে তোমার চলে যাওয়ার সময় আমরা ভাইবোনেরা হয়তো তোমার পাশে থাকতাম। আমরা তোমার এমন দুর্ভাগা সন্তান চলে যাওয়ার সময় একটা সন্তানের মুখও দেখে যেতে পারোনি। তারপরও তুমি অনেক পূণ্যবান মা। (২০০৬ সালের ৯ই ফেব্র“য়ারী) কাউকে একটুও কষ্ট না দিয়ে মিনিটের মধ্যেই সবকিছু শেষ করে দিয়ে চলে গেলে। বাবাও বুঝতে পারেনি মা তুমি যে চলে গেছ। তোমার জন্য বাবা এলোপাতাড়ি দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে এনেছে। তখন তো সব শেষ মা। আগের সপ্তাহে তোমার সাথে দেখা করে এসেছি। সেই দেখা যে শেষ দেখা হবে বুঝতে পারিনি মা। তুমি আমার জন্য পিঠা বানিয়ে রেখেছিলে। আমাকে আদর করে ভাত খাইয়েছ। আবার আমার ব্যাগ হাতে নিয়ে আমাকে গাড়ীতে তুলে দিয়েছ। জানো মা, সেদিন তোমাকে দেখে আসার পর থেকে আমার মনে একটা দাগ কেটে গিয়েছিল। আমার থেকে সবসময় মনে হয়েছে তোমার মুখখানি খুব ফ্যাকাসে সাদা হয়ে গেছে। বুঝতে পারিনি মা, চলে যাবে বলে মনের ভিতরে গভীর বেদনার ছাপ পড়েছিল। মা তোমার বিহনে আমার খুউব খুউব কষ্ট মা। একটা সুন্দর শাড়ী দেখলেই তোমার কথা মনে পড়ে। মনে হয় এই শাড়ীটা পরলে তোমাকে খুব মানাতো। তোমাকে শাড়ী কিনে দিলে তুমি কত আশীর্বাদ করতে। তুমি তো নেই মা --- কার জন্য শাড়ী কিনব? আমি শুধু সবসময় তোমার বয়সী মহিলাদের দিকে হা করে চেয়ে থাকি আর তোমার কথা ভাবি। জানো মা, তুমি চলে যাওয়ার ছয় মাস হয়নি, বাবুল কাকাও তোমার মত হঠাৎ করে চলে গেছে খুব অসময়ে। কেন এমন হলো মা? তুমি বেঁচে থাকলে খুব কষ্ট পেতে মা। সবশেষে বলি মা ---- আমাদের ভান্তে সবসময় তোমার কথা বলে, ভান্তের নাকি মনে হয় তুমি সবসময় আশেপাশেই আছ। তুমি নেই, একথাটা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। আরো এটা কথা না বললে খুব অপরাধী হবো মা। সেটা হচ্ছে তোমার মৃত্যুর শবানুষ্টানে দেশবাসী সবাই যেরকম সহযোগীতা করেছে, সেটা কোনদিন ভুলতে পারব না। বিশেষ করে অনিল দাদুর পুরো পরিবার, প্রদীপ দাদা, দীলিপ দাদা, শিলীপ দাদা এবং আরো সবাই অকৃপণ সহযোগীতা করেছে। তাঁদের সবার কাছে আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। মা যদি তুমি পারো আবার ফিরে এসো, তোমার প্রিয় সন্তানদের কাছে। আমার এই আবদারটুকু রাখবে না মা? সারাজীবন তো শুধু জ্বালিয়েছি বিভিন্ন বায়না ধরেছি, এটা দিতে হবে, ওটা দিতে হবে। সব তো দিয়েছ মা, পূর্ণ করেছ সব আশা। এইবার শেষ আবদারটুকু রেখো মা। তোমাকে খুউব দেখতে ইচ্ছে করছে মা। যে মা-কে এক সপ্তাহ না দেখলে ছটফট করতাম প্রতিনিয়ত, সেই মাকে আজ সাত বছর না দেখে কিভাবে আছি? তুমিও মা কিভাবে আছো আমাদের না দেখে? খুউব জানতে ইচ্ছে করে -------কেমন আছো মা?

ইতি
তোমার আদরের মেয়ে 

মেহেদী হাসান এর ছোট গল্প

চাপা হাসির রোল
মেহেদী হাসান

শীতকালের সকালবেলা।
ঘিঞ্জি গ্রাম, নিকট দিয়ে এঁকে বেঁকেবয়ে চলা ছোট নদী, লাগোয়া পাকা সড়ক;  কুয়াশা ভেদ করেএকটি বেকারিভ্যানকেবেশ আয়েশ করে চালিয়ে নিয়ে আসতে দেখা যায়জীর্ণশীর্ণগোছের একটি চ্যাংড়া ছেলেকে।
বেকারী ভ্যানটি বড়সড় একটি মনোহারী দোকানের কাছাকাছিচলে আসে, ছেলেটির প্যাডেল মারা বন্ধ হয়। দোকানদারের হাহাকার ভরা কন্ঠ, মাথায় প্যাঁচানো মাফলার ভেদ করে, তার কানে এসে ঢোকে। কোন বিষয়ে কথা হচ্ছে তা সে স্পষ্ট শুনতে না পেলেও, কথা বলার আবেগাক্রান্ত ভাবে,এটুকু শুধু বুঝতে পারে যে, দোকানদার তারকোন এক সুহৃদের সাথে বড় ধরনের কোন দুঃখেরব্যাপার নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেছে।
ভ্যানটি মন্থর গতিতে এগিয়ে এসে দোকানটির সামনে পৌছায়, কড়া ব্রেক কষেচ্যাংড়া ছেলেটি সিট থেকে নেমে পড়ে, দোকানের ভেতরে তাকায়- কি কি মাল দোকানে মজুত আছে আর কি কি মাল দিতে হবে সেই হিসাব কষতে। শিশির ঝরার মতদোকানদারের মুখ থেকে বের হয়ে আসতে থাকাকথাগুলো এবারক্রমে ক্রমে তার কাছেসুস্পষ্ট হয়ে উঠে। কিভাবে সেপোল্ট্রি মুরগীর কারবারে গিয়েবড় ধরনের মার খেয়েছে, দোকানদারের হতাশ কন্ঠে তারই ম্লানবর্ণনা-সুহৃদের মুখোমুখি বসে।ছেলেটি, শুনতে শুনতেই, ভ্যানেরপিছন দিকের পাল্লা খুলে বেকারী সামগ্রী বের করার কাজে হাত লাগায়; কাজের এক ফাঁকে, আড়চোখে মানুষ দুটির দিকে আবার একনজর তাকিয়ে নেয়।
শীতকালে পেট্রোলিয়াম জেলি না মাখলে মুখের চামড়া যেমন চড়চড়ে হয়ে থাকে, দোকানদারের চোখেমুখে সহানুভূতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তেমন ধরনে পরিস্ফুট। আর সুহৃদ ব্যাক্তিটির মুখে, লেগে থাকা আবেগের লঘুভাবকে থমথমে অবস্থায় রুপান্তরের, একটি কষ্টকর প্রচেষ্টা- নিজের আর্থিক ক্ষতির কথা উজাড় করতে থাকা লোকটি বাদে যে কেউ একবার তাকানোতেই ধরে ফেলবে। সুহৃদ ব্যাক্তিটিদোকানদারের বলতে থাকা কথার ফাঁকফোকরেছোট ছোট আহহারে! ইশ! হায় হায়! নানা ধরনের সহানুভূতিসূচক শব্দ এমনভাবেউচ্চারণ করছে যেন মুখের চড়চড়ে চামড়ায় আলতো হাতে পেট্রোলিয়াম জেলি মেখে দিচ্ছে।লোকটির মুখে লেগে থাকা অসহায়ত্বের চড়চড়ে ভাব সহানুভূতির হালকা লেপনে কিছুটা মুছে যাওয়ার সাথে সাথে জোরালো হয়ে উঠছেআকুতির বড় বড়ছোপ, ইতোমধ্যে চোখে জল জমার উপক্রম। সমানুপাতেতার কন্ঠে হতাশার মাত্রা এমনভাবে বেড়ে চলে যেন তাতে সমব্যাথী হয়েসুহৃদের মুখ ফুটে বের হয়ে আসা-টেনশন কইরা আর কি কোন লাভ অবো, বারো মুস্কিল তের আসান, খোদায় যা করে মঙ্গলের নিগাই করে, আবার শুরু কইর্যা  দ্যান দেহি, এই দোকানডাও তো মোটামুটি বালাই চলে, বেবাক ঠিক অইয়া যাব- হরেক রকমের আশার বাণী মূলক কথার ছিটার বিনিময়ে যাতেকরে কারবারে লাখ দুই টাকা মার খাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে যায়।
ছেলেটির,ভ্যান হতে পণ্যসামগ্রী বের করতে থাকা, অস্তিত্ব এতক্ষণেও টের পায়নি  দোকানদার- মনোবেদনা উজাড় করার কাজে এতই সে মশগুল। অবশেষে, সুহৃদ ব্যাক্তিটিই তাকে জানিয়ে দিল চ্যাংড়া ছেলেটিরআগমনের খবর। স্বাভাবিকভাবে মনে হয়,দোকানদারের কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে ভেবে সুহৃদ ব্যাক্তিটি এখনকার মত উঠে যেতে চাচ্ছে, ব্যাস্ততা কাটলে আবার আসবে সমবেদনা জানাতে।বিদায় নেওয়ার জন্য, যাহোক, সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল; আরো কাছে এগিয়ে এসে দোকানদারের পুরু জ্যাকেটের উপর হাত বোলাতে বোলাতে গলার স্বরটাকে আগের চাইতেও বেশ খানিকটা নরম করে আরো কিছু সহানুভূতিসূচক কথাবার্তা বলল। চলে আসতে আসতে, বার বার মুখ ঘুরিয়ে, যুত করে বেশ কিছু আশার বাণী শোনাতেও ভুললনা সে।
দোকানদার করুনভাবে, বিরক্তিসহকারেছেলেটির দিকে চোখ বেঁকিয়ে তাকাল। সুহৃদের উঠে যাওয়ার জন্য, এককভাবে তাকেই দায়ী করে বসল সে। তবে এই উঠে যাওয়ার পেছনে আরেকটা গোপন কারন আছেযা সহানুভূতি পেতে থাকা লোকটির পক্ষে এই মুহুর্তে হয়ত কল্পনার সুবিস্তৃত আওতার মধ্যেও আনা সম্ভব নয়। এবার বেকারী সামগ্রীগুলো একে একে বুঝে নেওয়ার পালা লোকটির।এরপর ছেলেটি অল্প একটু দূরে রাস্তার অপর পাশেমনোহারী কাম চায়ের দোকানের দিকে ভ্যানটিকে চালিয়ে দিল।
অপর দোকানটির কাছাকাছি আসতেই ছেলেটি শুনতে পেল ঘর থেকে বের হয়ে আসা চাপা হাসির আওয়াজ। এই দোকানের একটি ঝাপ খোলা, অপরটি বন্ধ। ছেলেটি যখন ভ্যান নিয়ে দোকানের ঝাপ খোলা অংশের সামনে এসে দাঁড়াল তখন দেখতে পেল ঐ দোকানদারের সুহৃদ এবং এই দোকানদার বেশ আমেজ করে সিগারেটের ধোঁয়া ঘরময় ছড়িয়ে দিচ্ছেএবংতাদের সম্মিলিত হাসির শব্দ খানিকটা উচ্চ হতে শুরু করলেই হাসিটাকে মাঝপথে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলছে, “আস্তে, আস্তে-শ্যুইনা ফালাবো, শ্যুইনা ফালাবো।”সুহৃদ ব্যাক্তিটি মাঝে মাঝেই হাসির বেগ কিছুটা কমিয়ে এনে ঐ দোকানদারের দুঃখভারাক্রান্তভাবে কথা বলার ঢং নকল করে,খানিকপূর্বে শুনে আসা কথাগুলো, একটু একটু করে বলে যাচ্ছে- ভাবটি এমন-ব্যাপারটি যেন একঝলকেই ফুরিয়ে না যায়; চাড়িয়ে চাড়িয়ে আরো বেশ কিছুক্ষণ উপভোগ করতে পারে। এই কুয়াশাচ্ছন্ন বিষন্ন শীতের সকালে তা যেন খেজুরের মিষ্টি রসের মত!সুহৃদ ব্যাক্তিটির একটি কথা বলা শেষ হতে না হতেই কথাটিকে ছাপিয়েউপচে পড়া উচ্চ হাসির রোল সাথে সাথেই সংক্রামিত হয়ে যাচ্ছে এই দোকানদারের মাঝে। উচ্চকিত হয়ে উঠাহাসির বেগ কমিয়ে আনা, দোকানদারের বলা কথার কিছু অংশ বলা, আবার উচ্চ হাসির রোল, আবার হাসিটাকে চেপে ধরা, আবার ফিসফিসিয়ে সাবধান বাণীর উচ্চারণ, মাঝে মাঝে সিগারেটে তীব্র টান এবং উচ্চ হাসির আওয়াজের সাথে জড়িয়ে বিশালাকারে ফাঁক হয়ে থাকা দুই ঠোঁটের মাঝখান দিয়ে ধোঁয়ার ব্যাপকারের নির্গমন।
চ্যাংড়া ছেলেটি, বেশ হতভম্ব হয়ে গেছে, দোকানের ঝাপ খোলা অংশের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। এর মধ্যেই আমোদে আচ্ছন্ন সুহৃদ ব্যাক্তিটি পাশেই কারো একজনের অস্তিত্বের চুম্বকাকর্ষণ অবচেতনে টের পেয়ে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দৃষ্টি পতিত হল ছেলেটির মেছতা পড়া বিব্রত মুখের উপর। মুহুর্তের মধ্যে সুহৃদ ব্যাক্তিটির মুখ ও ঠোঁট গ্রীষ্মের প্রখর রোদ্রে নেতিয়ে পড়া চারা গাছের মত ঝুলে পড়ল। জরুরী কাজের অজুহাতে, মাথাটা নুয়ে রাখা অবস্থাতেই, বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল সে। হাসি-তামাশা, জমজমাট আড্ডার এমন উষ্ণ পরিবেশ ছেড়ে সুহৃদ ব্যাক্তিটির এই হঠাৎ গোমাড়া মুখ হয়ে উঠে পড়াতে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার খানিকক্ষণ পর ছেলেটির দিকে চোখ পড়ায় দোকানদার ব্যাপারটা যেন আঁচ করতে পারল। তবেদুজনের একজনও ঠিকমত বুঝে উঠতে পারল না- সুহৃদ ব্যাক্তিটি মুহুর্তের মধ্যে কোন দিক দিয়ে বের হয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল।বাষ্পে পরিণত হয়ে যেন পাতলা কুয়াশার মাঝে বিলীন হয়ে গেছে!

মিশকাত উজ্জ্বল এর কবিতা

অনাদ্য দুঃখ নদী 
____মিশকাত উজ্জ্বল____

আমার আকাশে পূর্ণিমার মত জোছনাময়ী চাঁদ নেই,
তারা নেই_
জীবনানন্দ দাসের 'সোনালি ডানার চিল'
কুহুকুহু বসন্তের কোকিল
বিরক্তিকর কা কা করার মত দু'একটি কুশ্রী কাক
প্রত্যাখ্যাত প্রেমের পুঞ্জীভূত দহনে অন্তর পুড়ে খাক

আধারাকীর্ণ একাকীত্ব আমায় কুরে কুরে খায়
জীবনের বাঁকে বাঁকে কেবলই না-পাওয়ার দুঃসহ বেদনার স্মৃতি নীরবে কাঁদায়
অন্তরজুড়ে সাহারা মরুভূমির মত সীমাহীন হাহাকার
দুঃখ কুড়াতে কুড়াতে অপস্রিয়মাণ সুখের ভাণ্ডার
কষ্ট সয়ে সয়ে পর্বতবৎ মন
বঞ্চনার তুষারপাতে আচ্ছাদিত ঈশ্বরপ্রদত্ত দেহধন!

হিমালয়ের বরফের মত দুঃখ গলে গলে পড়ছে তাই
আমার হৃদপিণ্ড থেকে নিরবধি...
আমি যেন অনাদ্য দুঃখ নদী

আক্তারুজ্জামান বাপ্পির ছোট গল্প

ভুলের মাসুল

প্রতিদিনের মতো আজো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে রাজু । খোলা চুল , গায়ের রঙ শুভ্র সাদা , চোখ দুটি টানা টানা, মনে হয় চোখ দুটিতে সবসময় চঞ্চলতা খেলা করে যা রাজুর অনেক ভাল লাগে ।। ইচ্ছে করে কথা বলতে তা আর হয়ে উঠে না ।। তার মতো নিন্ম মধ্যবিত্ত ছেলেদের জন্য ভালবাসা মানে বিলাসিতা ... তার বাবা গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক ... অনেক কষ্ট করে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে ... গ্রামে এস.এস.সি পাস করে শহরের একটি কলেজ এ ভর্তি হয়েছে … তাই দূর থেকে দেখেই চলে রাজু... আর মেয়েটা? মেয়েটার নাম ফারিহা ... বড়লোক বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান । ছোটবেলা থেকে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে সে ... কোনদিন অভাব কি তা বুঝে নি ফারিহা ... প্রচণ্ড অহংকারী আর বদমেজাজি এই মেয়েটি ... কলেজ এর সব ছেলেরা এই মেয়েটি বললে জীবন দিতেও প্রস্তুত ।। বাজি ধরতে আর ছেলে ঘুরাতে সে ওস্তাদ ...
- দেখ দেখ আজো ক্যামন তাকিয়ে আছে ... মনে হয় তোর প্রেমে পরছে ।।
- এরকম ৮/১০ টা ছেলে প্রতিদিন আমার প্রেমে পরে আর উঠে ...
- তবে যাই বলিস ছেলেটা জোস ।। আমার সেই ভাল লাগছে ...
- হ আসলেই অনেক জোস ... কি সুন্দর একটা রংচটা শার্ট , ঢোলা প্যান্ট , চোখে চশমা আর মাথায় তেল লেপটে আঁচড়ানো ।। এ রকম পিস এই শহরে এই একটায় আছে , কি বলিস …
- এই আমার জান রে কিছু বলবিনা ।। আমি ওরে অনেক লাবু করি !!! হা হা হা
- এতো পিরিত ।। যা যা যাইয়া গলা ধইরা ঝুইলা পর ...
- চাইয়া থাকে তোর দিকে আর ঝুলমু আমি ...
- যা তোরে দিয়া দিলাম ।। এখন যাইয়া জান জান কর
- তবে যাই বলিস ছেলে টা অনেক সহজ সরল , বলদ টাইপের ... এক কথায় গ্রাম্য খেত
- এইসব গ্রাম্য খেত দের সাথে প্রেম কইরা মজা আছে ।। ইচ্ছা মত ঘুরানো যায়, যা বলে তাই শুনে , জীবন ও দিয়া দিতে পারে ।।
- তোর মতিগতি তো ভালো লাগতেছে না ।। তুই কি খেতের লগে প্রেম করবি নাকি ।।
- আরে দূর প্রেম না ।। একটু টাইম পাস করমু ।।

কাল রাতে রাজুর ঘুম হয়নি ... সারারাত বিছানায় গড়াগড়ি করেছে । রাতে ভালমতো খায়নি ।। তাই আজ সকাল সকাল কলেজ এ এসেছে কলেজ হোটেল এ নাস্তা করার জন্য , এখানে কম খরচে খাওয়া যায় ।। একটা টেবিল এ বসে পরল সে ।। রাজু দেখতে পেল ফারিহা হোটেল এ ডুকছে ... আজ ওকে আরও সুন্দর লাগছে ... নীল রঙের সালওয়ার কামিজ , চুল খোলা ... যেন নীল পরী ... ফারিহা এসে রাজুর টেবিল এ বসে পড়লো ।।
- হাই , আমি ফারিহা ... তুমি ?
- আমিইইই ...
- তোতলাচ্ছ কেন ... আমি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক ...
- আমার নাম রাজু ...
- তোমাকে প্রায়ই দেখি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাক ...
- কই নাতো ...
- মিথ্যা বলবে না একদম ... আমি সব দেখি, বুঝতে পারি ... তোমার কি আমাকে ভাল লাগে ...
- না না ... সত্যি বলছি আমি তাকাই না।।
- আচ্ছা তুমি না ।। আমি তাকাই থাকি , তোমাকে আমার ভাল লাগে ... তোমার মোবাইল নাম্বার টা দাওয়া যাবে
- আমার মোবাইল নাম্বার !!
- হা , তোমার মোবাইল নাম্বার
- নাও ********
- ধন্যবাদ ।। আমি তোমাকে ফোন দিবো ।। টা টা

শুরু হল রাজুর জীবনের এক নতুন অধ্যায় ... প্রতিদিন ফারিহার সাথে তার কথা হয় ।। কথা বলতে বলতে রাজু ফারিহাকে ভালবেসে ফেলে, ফারিহাকে বলার সাথে সাথে ফারিহাও রাজি হয়ে যায় ... কলেজ সময় এর বাইরেও তাদের দেখা করার পরিমাণ বেড়ে যায় , সেই সাথে বাড়তে থাকে রাজুর খরচের পরিমাণ ।। ফারিহাকে গিফট , খাওয়ানো , ঘুরতে যাওয়ার খরচের জন্য বাবার কাছে মিথ্যা বলতেও রাজুর বিন্দুমাত্র বাঁধে না ... রাজু ভাবে ফারিহাকে সে পেয়ে গেছে, জীবনে আর কিছু না পেলেও চলবে ... রাজুর ভুল ভাঙ্গতে বেশিদিন সময় লাগে না ।। ফারিহা তুচ্ছ কারনে রাজুর সাথে ব্রেকআপ করে ... রাজু ভেঙ্গে পড়ে তবে আশা ছেড়ে দেয় না।। প্রতিদিন ফারিহাকে বুঝাতে থাকে ।।রাতের পর রাত ফারিহার বাসার সামনে যেয়ে দাড়িয়ে থাকে ... একসময় ফারিহা বিরক্ত হয়ে যায় এবং রাজু কে বলে কাল কলেজ শেষে তুমি আর আমি আমার এক বন্ধুর বাসায় দেখা করব ... রাজু খুব খুশি হয় তার ফারিহা আবার তার জীবনে ফিরে আসছে ... পরদিন রাজু আর ফারিহা কলেজ শেষে দেখা করে ...
(পরেরদিন কলেজ এর ক্লাস এ )
- বদিউল ইসলাম রাজু কে ?
- জি আমি ...
- প্রিঞ্ছিপাল স্যার আপনাকে তার তার রুমে ডাকে ...
পিওনের পিছে পিছে রাজু স্যার এর রুমে যেয়ে ঢুকে ... দেখতে পায় ওখানে ফারিহা , তার কিছু বান্ধুবি, কলেজ এর কয়েক জন শিক্ষক ও আছে ... প্রথম কথাটি প্রিঞ্ছিপাল স্যার বলে ...
- তোমার নাম রাজু ?
- জী স্যার ।
- বাবা কি করে ?
- গ্রামের একটা স্কুল এর শিক্ষক ...
হঠাৎ ফারিহা বলে উঠে , স্যার এটাই সেই লম্পট , বাজে ছেলে যে আমার ইজ্জত হানি করতে চেয়েছিল এবং ছবি তুলছে ... আমি এর বিচার চাই ... রাজু শুনে অবাক হয়ে যায় এবং বলে বিশ্বাস করুন আমি এসবের কিছু জানিনা প্রিঞ্ছিপাল স্যার বলে তুই কিছু জানিস না তাই না, তাহলে এই ছবি গুলো কি ,বলেই স্যার কিছু ছবি রাজুর দিকে ছুড়ে মারে ... রাজু হাতে নিয়ে দেখতে পায় কালকে বিকালের কিছু ছবি ... রাজু বলে উঠে স্যার , আমার কথা একবার শুনেন ... তোর বাপ শিক্ষক না , শিক্ষক নামের কলংক ... যে এমন ছেলের জন্ম দিছে ... তোকে কলেজ থেকে বহিস্কার করা হল , প্রিঞ্ছিপাল স্যার বলে... রাজু কান্নায় ভেঙ্গে পরে এবং দেখতে পায় ফারিহার মুখে মিটিমিটি হাসি ... রাজু রুম থেকে বের হয়ে আসে ... সেদিনের পর থেকে রাজুকে আর কলেজ এ দেখা যায় না , দেখা যায় না শহরেও ... বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তাও কেউ জানে না ...

* * * * * * * *

ফারিহার মনে আজ অনেক আনন্দ ।। ৫ বছর প্রেম করার পর আজ তার মনের মানুষ ফাহিমের সাথে তার বিয়ে হতে যাচ্ছে ... ইশ ফাহিম টা যে কেনো এখনো আসছে না !! বাহিরে অনেক শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে , নিশ্চয় ফাহিম এসেছে , ফারিহা মনে মনে বলে ... হঠাৎ ফারিহার রুমে হাসতে হাসতে ফাহিমের আত্মীয়রা ঢুকে পরে ... সবাই ফারিহাকে দেখছে , আজ ওকে অনেক সুন্দর লাগছে ... ফারিহার মা এসে বলে কি খালি ভাবিকে দেখলেই হবে , আমাদের ও একটু দেখেন ।। ফাহিমের মা বলে হা , বেয়াইন সাব চলেন , এই তোরা আয় ... ফাহিমের খালাতো বোন ঝুমকা বলে , খালা তোমরা যাও ... আমি ভাবির সাথে থাকি ... সবাই রুম থেকে বের হয়ে এল ... ঝুমকা ফারিহা কে বলে তোমার নাম আসিফা রহমান ফারিহা না? ফারিহা বলে , হা ... তুমি নীলপুর কলেজ এ পড়তে না।
ফারিহা বলে হা , তুমি কিভাবে জান ।। ঝুমকা বলে , আমিও ঐ কলেজ এ পড়তাম , তুমি বস আমি আসছি ...
ঝুমকা যেয়ে ফাহিম কে বলে ভাইয়া শোন , তোর সাথে আমার কথা আছে ... ফাহিম বলে কি বলবি, বল ।। ঝুমকা ফাহিম কে সব খুলে বলে ।। ফাহিম প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না... ঝুমকা অনেক বলার পর বিশ্বাস না করে পারে না ... ফাহিম ফারিহার রুমে এসে ঢুঁকে ...
- ফারিহা , তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে ...
- বল ফাহিম
- তুমি রাজু নামের কাউকে চিনো ...
- কই , নাতো ...
- মিথ্যা বলবে না ...
- হা চিনি ... ও আমার সাথে কলেজ এ পড়তো
- ছিঃ ফারিহা ছিঃ তুমি এত নীচ , দুশ্চরিত্রা ... আমি এটা কল্পনাও করি নি ...
- এসব তুমি কি বলছ ... বিশ্বাস কর তুমি যা ভাবছ তা কিছুই না।। ও আমাকে ভালবাসত ,আমি ওকে বাসতাম না ...
- ওহ ভাল ভাল , ভাল না বেসেই রুম ডেটে গিয়েছিলে ...
- ফাহিম বিশ্বাস কর ... আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি ...
- তোর মতো মেয়ের ভালবাসা আমার দরকার নাই ... তুই একটা বেশ্যা , দুশ্চরিত্রা
বলেই ফাহিম রুম থেকে বের হয়ে যায় ... বাহিরে অনেক হট্টগোল শুনা যাচ্ছে ... ফারিহা শুনতে পায় ফাহিম বলছে , আমি এই মেয়েকে বিয়ে করব না ,মা চল ... ফারিহার মা ,বাবা সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পরে ... ফারিহার মায়ের হঠাৎ ফারিহার কথা মনে পরে ।। সে দৌড়ে ফারিহার রুমে আসে ... দেখতে পায় ফারিহা বিছানায় ঘুমাচ্ছে ... তার মেয়েকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে ... পায়ে কিছু একটার স্পর্শ পেয়ে ফারিহার মা সেটা হাতে নিয়ে দেখতে পায় সেটায় লেখা “বিষের বোতল”

আক্তারুজ্জামান বাপ্পি

মুহাম্মদ ইউসুফ এর ছড়া

পচাকান, কানপচা
...  মুহাম্মদ ইউসুফ

পচা কান ভাল কথা শুনে না
পচা কান ভাল গান শুনে না
পচা কান পচা মন পচা চোখ-দৃষ্টি
পচা মনে খর-রোদ নেই জল-বৃষ্টি

পচা চোখ, পচা কথা, পচা নীতি-আইন
পচা পথে করে যাই জীবনের সাইন ( ? )

বাড়ি গাড়ি নারী নিয়ে আছি মহাসুখে ( ? )
তুমি-আমি আমরা দোজখের মুখে !!

ভাল কথার আসছে শুভ দিন
মন ঘুরিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে
পাল্টে ফেলুন দ্বীন ।

... মুহাম্মদ ইউসুফ এর কবিতা

বেগমপাড়া, বাক্যহারা
... মুহাম্মদ  ইউসুফ

আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা
বেগমপাড়ায় যাই
লুটের টাকার মালা পরে
বেগমপাড়ায় যাই !!

বেগমপাড়ায় বেগম থাকেন
সাহেব থাকেন কই ?
আমজনতার রক্তচোষা, কইলজাচোষা
ওই-যে সাহেব ওই !!

সাহেব কারা, বেগম কারা ?
শাসন করেন যারা ?
অর্থ-শাসন, রাজ্য-শাসন
আমরা বাক্যহারা !!

লক্ষ-কোটি বেকার গরীব
দিন-মজুরের দেশে
বেগমপাড়ার সাহেব পেলাম
দেশকে ভালবেসে !!

ওয়াসিম রহমান সানির কবিতা

এই প্রাণ লুকিয়ে আছে
-ও য়া সি ম র হ মা ন সা নি।

চৈত্রের নিশি তারার মাঝে
নির্ঘুম ফাল্গুনী চাঁদের রাতে,
নবান্নের নব পিঠার আমেজে
পল্লী বাউল গানের আসরে
আমার এই প্রাণ লুকিয়ে আছে।

ধানক্ষেতের চিপ চিপ সরে
অগ্রাণের তুর ভরা সবুজ মাঠে,
ভোরের কৃষকের লাঙল কাধে
বাংলা জননীর সবুজ-শ্যামল সাঁজে

আমার এই প্রাণ লুকিয়ে আছে।

শুভ্রসাদা বেলী ফুলে
নিটোল হাওয়ায় কাঁশবনে
লাল রঙা ঐ কলমী ফুলে
শিশির ভেজা দুর্বা ঘাসে
আমার এই প্রাণ লুকিয়ে আছে।

পল্লীগাঁয়ের মাটির গন্ধে
সহজ-সরলা ঐ বালিকার সঙ্গে
বিরহী প্রিয়ার হৃদ পিন্ডে,
উদাস দ্বীপ্রহর কদম্ভ তলে
আমার এই প্রাণ লুকিয়ে আছে।

নিশি ভোর জেগে জেগে
জোনাকীর ঝিলমিল আলোতে,
জারী-সারী বাংলা কাব্যে
পুথিগাথাঁ ও যাত্রার আসরে
আমার এই প্রাণ লুকিয়ে আছে।

চির চেনা শীতের কমলা রৌদ্রে
নদীর তীরে রোদ্র স্নানে,
গ্রীষ্মের ঘোলা পুকুর জলে
একঝাঁক বাধঁন হারা বালকের মনে
আমার এই প্রাণ লুকিয়ে আছে।

সামিন রহমানের কবিতা


                                  নিবেদন
এই রৌদ্র সময়ে, আমি আমের মুকুলে, খুব ঘ্রাণের দুকূলে, 
যদি মিশে যাই মিশে যাই,
কিংবা শহরের আঙ্গিনায় মুছে ভ্রান্তি, ইটের ছায়াতে,
খুব ক্লান্তিতে,
যদি আজ, ডুবে যাই ডুবে যাই,
যদি রোদেলা এক বৃষ্টির মায়াবী আদর আমায় 
হঠাৎ, খুব হারাবার দুটো ডানা আর একটি দিগন্ত এনে দেয়, 
যদি হিংস্র বাতাস আর রাক্ষসী প্যাঁচামুখো মেঘগুলোর
বেদম অট্টহাসিতে আমিও খুব হাসতে চাই, 
যদি আজ ধোঁয়া, ঘাম, মুদ্রা, আর ব্যস্ততাকে 
দিয়ে বিদায়
প্রতিটি সবুজ পাতায়, রঙ্গে মিশে  
তারাদের সাথে, হঠাৎ  খুব কথা জাগে, নীরবতা জাগে,   
কিংবা একটি মেঘমুক্ত রাতের আকাশের অজস্র ছায়াপথে,
জ্বলজ্বলে ছেঁড়া শান্ত আঁধারে সুযোগ মেলে
খালি পায়ে হাঁটবার, 

আমায় কি ছুটি দিবে জীবন?
আমায় কি ছুটি দিবে?
বৈশাখ বড় ডাকছে আমায়, ডাকছে।


      মনপুরা 

এভাবেই, 
খুব অচেনা আর খুব আপন, খুব মুগ্ধ 
এই রাস্তাটি ছিল খুব একা, কাদাটে আর ঘোলাটে
তার দুপাশে ছিল বিলীন আকাশ আর অঢেল তামাটে 
জলের সুখের সংসার ছিল বোহেমিয়ান পাগলাটে হাওয়া,
ঘাস, খড় ছিল জেলে, জ্বাল, শামুক আর মাছ, তাদের কেমন মাটি 
মতন মাংস, রঙ, একটি জীবন ছবি কেমন পরিপাটি
সব সেক্ষণে, একা ওই ফড়িং আর চিলের মত, নীল ছাওয়া 
নীরব এই মনপুরায় ছিলাম আমিও খুব মুগ্ধ আর খুব অবাক 
খুব মুগ্ধ আর খুব অবাক আর খুব আনমনা
তবে ঠিক এভাবেই থাক সব, ঠিক এমনি করেই,
চিরকাল, প্রিয় মনপুরা আমার, 
খুব... খুব অচেনা আর খুব আপন, 
আর খুব মুগ্ধ... 
এভাবেই
 

          এই রোদ 

এই রোদ আর এই উত্তাপ
আজ আমাদের খুব কামড়ায়।
ধুলোয় রাস্তায় আমাদের পায়ের ছাপ,
হারায় রঙ, আর ফোলা ফোলা গরম ফোস্কাগুলো আমাদের চামড়ায়  
কেমন সাদামাটা আল্পনা আঁকে।
আর এভাবেই খুব নিবিড় মায়ামাখা,
দমবন্ধ, এই ইটের জীবন, ঝুলে থাকে,
ঝুলে থাকে লোকাল বাসে, খুব শ্রান্ত আর খুব একা।

এই রোদ আর এই উত্তাপ  
আজ আমাদের আগুনকে খুব পোড়ায়  
হঠাৎ কেমন জাপটে ধরে রাগ, তাপ, পাপ, চাপ
আর, ঠিক বিস্ফোরিত হই যেন,  আমাদের ঘাম সাদা লাভা হয়ে জড়ায়
আমাদের হাড্ডিসার প্রাণ,    
আর আকাশ, পোকা আর রঙ, ঘাস, পাতা, ক্ষণ, 
ওরাও কেমন স্তবির হয়ে শোনে পোড়া এই ধরণীর সেই নিরস গান,    
যার শুকনো কঙ্কালে, আজ খুব জাগ্রত থাকে হিংস্র এক আগুনের আলোড়ন    
সেই গান আর আলোড়নে যখন আমরা বৃষ্টির জন্য নাচি
তখন আসলে, প্রতিদিনকার মতই, খুব মায়ামাখা,  
দমবন্ধ,  কঠিন এই ইটের জীবন, শুধুই পুড়ে আর ঝুলে থাকেআর ঝুলে থেকে বাঁচি  
আমারাও, বাঁচে পিপাসার্ত মৃত পাখি, কুকুর, তুচ্ছপ্রাণ, এই রাস্তায়, সেই একা। 

তবে এটা খুব ঠিক, এই রোদ আর এই উত্তাপ   
আজ আমাদের খুব কামড়ায়, আর কেমন
খায় যেন।


সামিন রহমান
১৮/ পশ্চিম নাখালপাড়া, 
 আল-মদিনা ভবন ( তলা),ঢাকা ১২১৫