অরুণ বহ্নি জ্বালাও
চিত্ত মাঝে
ইলা মুৎসুদ্দী
শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান।
সব দুর্বল সংশয় হোক অবসান।
তব জাগ্রত নির্মল নূতন প্রাণ
ত্যাগব্রতে নিক দীক্ষা
বিঘœ হতে নিক শিক্ষা
নিষ্ঠুর সংকট দিক সম্মান।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে
শুচি হোক ধরা ------- নববর্ষের নব প্রভাত যা কিছু গ্লানি, জীর্ণ-শীর্ণ-বিদীর্ণ, পুরাতন জরাগ্রস্থ
সব বৈশাখের রুদ্র দহনে পুড়ে অঙ্গার হোক, সকল না পাওয়ার বেদনাকে পিছনে ফেলে প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে শুচি
ও শুদ্ধ করে তুলতেই আবহমান কাল থেকে বাঙালির জাতীয় জীবনে আনন্দময় নতুন বছরের প্রত্যাশায়
নববর্ষ উদযাপিত হয়। বিগত বছরের যাপিত জীবনের কষ্ট
গ্লানি মুছে সংযোজন বিয়োজনের মধ্যে দিয়ে আমরা পালন করি পহেলা বৈশাখ। যার আমেজ ছড়িয়ে যায়
সবখানে। ছোট-বড় সবার হৃদয় মাতিয়ে দিতে পহেলা বৈশাখের রয়েছে আলাদা মাধুর্য। আমরা আশা করি ১৪২১
সালের নতুন ভোর কূয়াশার বুক চিরে টকটকে লাল সূর্যটা নিয়ে নতুন দিনের বারতা নিয়ে আসবে। পহেলা বৈশাখ মানেই
তারুণ্যের উচ্ছাস আর আনন্দের হিল্লোল। আবাল-বৃদ্ধ বণিতা, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী সকলেই
নতুন বছরের নব সূর্যের আলোয় আনন্দ উচ্ছাসে উদ্ভাসিত হয়ে ফুটবে। তাইতো কবির ভাষায়
বলতে হয় ---------
প্রভাতসূর্য, এসেছে রুদ্রসাজে
দুঃখের মাঝে তোমারি তূর্য বাজে
অরুণ বহ্নি জ্বালাও চিত্ত মাঝে,
মৃত্যুর হোক লয়।
বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় উৎসব পহেলা বৈশাখ। বাঙালি জীবনের অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন উৎসব পহেলা
বৈশাখ বর্ষবরণের দিনটি। পাহাড়ী বাঙালী সবাই এই দিনটিকে
ভিন্ন ভিন্ন আমেজে পালন করে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের
প্রধান তিনটি জাতিগোষ্ঠী ত্রিপুরা, মারমা এবং চাকমারা দিনটিকে যথাক্রমে বৈশুখ, সাংগ্রাই ও বিজু
উৎসব নামে দিনটিকে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিপালন করে আসছে। অবশ্য বর্তমানে তিন
জাতিস্বত্ত্বা যৌথভাবে বৈসাবি নাম দিয়ে পালন করা শুরু করছে দিনটিকে। বৈসাবি উৎসবের অন্যতম
আকর্ষন হচ্ছে পানি খেলা।
এই দিনটির সাথে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির
নিবিড় যোগ রয়েছে। গ্রামে এই দিনে মানুষ ভোর ঘুম
থেকে উঠে গবাদি পশুকে ¯œান করিয়ে তাদের গলায় মালা দেয়। বৈশাখের নতুন নতুন
ফুল দিয়ে মালা সাজিয়ে বাড়ির দরজায় টাঙিয়ে দেয়। তারপর নতুন জামাকাপড়
পড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যায়। প্রায় প্রতিটি বাড়িয়ে এ সময়
খৈ আর হাতে তৈরী লাড়– দিয়ে আপ্যায়ন করা
হয়। কোন কোন গ্রামে এ সময় বৈশাখী মেলা বসে। মেলাতে থাকে নানা
রকম কুঠির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানা রকম পিঠা পুলির আয়োজন। বন্ধুবান্ধবেরা একত্রিত
হয়ে বিকালে মেলায় বেড়াতে যায়। কোথাও কোথাও দিনটি উপলক্ষে
নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা কিংবা বলী খেলার আয়োজনও করা হয়।
শহরেও নানা বৈচিত্রে দিনটিকে উদযাপন করা হয়। কর্মচঞ্চল যান্ত্রিক
জীবন থেকে সবাইকে মুক্তি দেয় দিনটি। রাজধানী ঢাকায় ‘ছায়ানট’ এর শিল্পীরা সমবেত
কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরের সূর্যকে বরণ করে নেয়। রমনার বটমূলে দিনব্যাপী
চলে নানা আয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা
ইনষ্টিটিউটের ছাত্ররা এদিন মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রাটি চারুকলা
ইনষ্টিটিউট থেকে বের হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুণরায় চারুকলা ইনষ্টিটিউটে এসে
শেষ হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বিভিন্নভাবে অংশ নেয়। কারো হাতে থাকে ফেষ্টুন, কারো হাতে প্লে কার্ড। কেউ কেউ নিজেকেই
বর্ণিল সাজে সাজায় বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব মুখে অঙ্কন করে কিংবা রং বেরঙের মুখোশ পড়ে। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ
জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়।
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের মূল আয়োজন বসে ডি সি হিলে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক
সংগঠন দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মাধ্যমে দিনটিকে বরণ করে নেয়। এখানে অবশ্য বর্ষ
বিদায় ও বর্ষ বরণ এই দুই দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান থাকে। শিশু সংগঠন ‘ফুলকী’ তিন দিন ধরে উৎসবটিকে নানা আয়োজনে বরণ করে। এছাড়া নগরীর মহিলা
সমিতি স্কুলে বসে বর্ষবরণ মেলা বা বৈশাখী মেলা।
আমরা এবার ভিন্নভাবে নতুন আঙ্গিকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন
করব। কারণ আমরা বাঙালী জাতি, বীরের জাতি। আমরা আবারো তা প্রমাণ
করেছি । ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে আমরা দীর্ঘতম বিশ্ব মানব পতাকায়
গিনেজ রেকর্ডে স্থান করে নিয়েছি। সেই সাথে ২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা
দিবসে লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা গানটি পরিবেশনের মাধ্যমে আমরা আবারো সারা বিশ্বকে চমকে
দিয়েছি। আমাদের আছে সফলতার দীর্ঘ কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়
উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতার আনন্দ-উচ্ছাসে বাঙ্গালী জাতি নববর্ষকে ধারণ করবে এবার। মানবতা বিরোধীদের
মতো অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করা হচ্ছে সময়ের আবর্তনে। বিচার কাজ চলছে খুবই
দ্রুতগতিতে। যারা দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে
এদেশ স্বাধীন করেছে, আর যারা শহীদ হয়েছে তাদের সকলেই আজ কিছুটা হলেও তৃপ্ত। কারণ যুদ্ধাপরাধীরা
শাস্তি পাচ্ছে। বাঙালী জাতি কোন অন্যায়ের কাছে
মাথা নত করে না। বারে বারে তা’ প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য পহেলা বৈশাখ
আনন্দ-উদ্দীপনা আর বর্ণাঢ্য উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে দোলা দিয়ে যাবে। বাঙালি সং®কৃতির বৃহৎ আয়োজন
বৈশঅখী মেলা এবং নববর্ষ উদযাপন। নববর্ষে শিশু-কিশোর এবং তরুণ-তরুণীদের
সাজ-সজ্জায় থাকে ভিন্নতা। সেদিন মনে হয় সত্যিই আমরা মনে-প্রাণে
বাঙ্গালী। আমাদের সং®কৃতি আর ঐতিহ্যের
ধারক ও বাহক নববর্ষ। নতুনবছরের রঙীন সাজে আমরা নিজেদের
রাঙ্গিয়ে নেই, নববর্ষের আগমনে নতুন প্রেরণায় জেগে উঠি, উজ্জীবিত হই।
এক কথায়, এদিনটি বাঙালির জীবনে
নিয়ে আসে উৎসব আমেজ আর বসন্তের দিন। নানা রঙের পাঞ্জাবী আর আলপনা
আঁকা শাড়ি, লাল-সবুজ আর সাদার সংমিশ্রণে ফ্যাশনের নতুনত্ব সবাইকে মাতিয়ে
রাখে বৈশাখের গাটছড়ায়। দূর্যোগ কালীন সময় কিংবা দেশবিরোধীরা
যখন মাথাছাড়া দিয়ে উঠে তখন আমার উৎসব প্রিয়
বাঙ্গালীরা এই দিনের মতো করে সম্মিলিত ভাবে
জেগে উঠলে দেশ থেকে সকল অপশক্তির নিরোধ হবে, উন্নয়নের জোয়ারে
উন্নতির শিখরে পোঁছাবে বাংলাদেশ।
অনেক ভালো-মন্দের, সুখ-দুঃখের সম্মিলনে
আমাদের জীবনলিপি। বিগত বছরে আমাদের কারো জীবনে
ঘটে গেছে অনেক দুঃখময় ঘটনা, আবার কারো জীবন আনন্দ-ভালোবাসায় হয়েছে পরিপূর্ণ। অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা থাকবেই। সবকিছু ভুলে গিয়ে
সকল দুঃখ-হতাশা, গ্লানি, ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে সততা, একাগ্রতা, সৃষ্ঠিশীলতা প্রয়োগ
করে আমরা এগিয়ে যাব দৃঢ় প্রত্যয়ে। ১৪২১ সাল আমাদের সবার জন্য
নিয়ে আসুক নব নব প্রাপ্তি আর নব নব আনন্দ।
স্বাগতম বাংলা নববর্ষ ১৪২১ বঙ্গাব্দ। সকল অশুভ শক্তিকে
প্রতিহত করে নতুনের শুভ সূচনা হোক। সকলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। পরিশেষে কবিগুরুর
চরণ দিয়েই শেষ করছি ঃ
চলো যাই কাজে মানবসমাজে, চলো বাহিরিয়া জগতের
মাঝে,
থেকো না অলস শয়নে, থেকো না মগন স্বপনে।।
যায় লাজ ত্রাস, আলস বিলাস কুহক মোহ
যায়।
ঐ দূর হয় শোক সংশয় দুঃখ স্বপনপ্রায়।
ফেলো জীর্ণ চির, পরো নব সাজ, আরম্ভ করো জীবনের
কাজ
সরল সবল আনন্দমনে, অমল অটল জীবনে।।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।